ছবি: ২৯ এপ্রিল ২০১৭ |
ভর্তির পূর্ব থেকেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সাথে আমার পরিচয়। ভর্তির পর সে পরিচয় আরো ঘনিষ্ট হয়। ডায়না চত্বরের সবুজ গালিচা, অনুষদভবন ও বিজ্ঞান অনুষদের সাদা-খয়েরির অপূর্ব স্থাপত্য শৈলী আর তার চারপাশের সবুজের সমারোহ, সে সবুজের বিছানায় শরৎকালে ছোট ছোট কাশফুল- যেন এক স্বর্গীয় ছবি। এমন ছবির প্রতিও আমি মান-অভিমানে জড়িয়ে পড়ি, স্নাতকোত্তর ফলাফলের পর, আশাহত হয়ে। এরপর সে মায়াবী ক্যাম্পাসে আর যাইনি। কিন্তু সময় যত অতীত হয়েছে, হচ্ছে ততই ক্যাম্পাসের সব ‘বিরহ’ই যেন মধুর হয়ে রাঙিয়ে তুলছে মন। হয়ত অন্যদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি; এ কারণেই মনে হয় ১৪ বছর পর আমরা আবার মিলন মেলায় সমবেত হতে চলেছি।
আমার সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য- জানি না; ক্যাম্পাসে প্রায় ছয় বছর ইতিহাস অধ্যয়নের পরও সে অভ্যাস বা বদঅভ্যাস ত্যাগ করতে পরিনি। বরং নেশায় পরিণত হয়েছে। বিশেষত বাংলার ইতিহাসের অনালোচিত বিষয় এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ইতিহাসের বিকৃতি আমাকে ভীষণভাবে ভাবায়।
ছবি: ২৯ এপ্রিল ২০১৭ |
সে ইতিহাস বিকৃতির চরম এক দৃষ্টান্ত হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে ইবি ক্যাম্পাসের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য ‘মুক্ত বাংলা’। বিশ^বিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে ডানদিকের সবুজ চত্ত্বরে এর অবস্থান। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের মহান বিজয় দিবসে এর উদ্বোধন করেন তৎকালীন ভিসি প্রফেসর মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক। গুণী ভাস্কর রশীদ আহমেদ ‘মুক্ত বাংলা’র নকশা তৈরি করেন। এ ভাস্কর্যটি মূলত সাতটি স্তম্ভ সম্বলিত গম্বুজ; যার উপরে রয়েছে মুষ্টিবদ্ধ হাতে ধৃত একটি রাইফেল। চত্বরস্থ একটি লোহা-টিনের গোলাকার ফলকে ‘মুক্ত বাংলা’র গঠন-শৈলী বর্ণনা করা হয়েছে। শুরু এভাবে- “ক. সাত সদস্য বিশিষ্ট মুজিবনগর মন্ত্রিসভার প্রতীক সাতটি স্তম্ভ”.... (এরকম আরো আটটি বর্ণনা আছে, সেসব নিয়েও কিছু প্রশ্ন তোলা যায়)। কার্যত এ সাতটি স্তম্ভ শীর্ষভাগে দুদিকে প্রসারিত হয়ে একটি গম্বুজ তৈরি করেছে। আমার প্রশ্ন স্তম্ভের সংখ্যা নির্ধারণ নিয়ে- যে মুজিবনগর মন্ত্রিসভার সদস্য সংখ্যার ভিত্তিতে সাত গৃহীত হয়েছে, সে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সংখ্যা কখনও সাত ছিল না। এ তথ্য গাণিতিক, নয় কোন আপেক্ষিক বা তাত্ত্বিকÑ সেখানে কী করে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে ‘মুক্ত বাংলা’ নির্মিত হতে পারে?
বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কাজের মতো ‘মুক্ত বাংলা’র পরিকল্পনাও নানা ধাপে অনুমোদিত হয়েছে, এরপরও কিভাবে এ ভুল হলো? ভাস্কর রশীদ আহমেদ কি করে এ ভুল তথ্য দিয়ে ভাস্কর্যের পরিকল্পনা করলেন? ইতিহাসের ছাত্র হয়ে ভিসি মহোদয়ই বা কোন বিবেচনায় এ বিকৃত ভাস্কর্য উদ্বোধন করলেন? সে সময়ে এবং পরেও অনেক পত্রিকায় ‘মুক্ত বাংলা’র উপর ফিচার প্রকাশিত হয়েছে। কেউ প্রশ্ন তোলেনি। আরো বিস্ময়ের বিষয় হলো কোন ছাত্র-সংগঠনও এর প্রতিবাদ করেনি, করেনি শিক্ষক সংগঠনও; যদিও তারা (শিবির বাদে) মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য স্থাপনের পক্ষে আন্দোলন করেছিল। সে সময় বিভাগের এক স্যারের সাথেও কথা বলেছি, তাঁর কাছেও যৌক্তিক কোন ব্যাখ্যা পাইনি।
এতকিছুর পর কখনো কখনো আমার মনে হয়েছে তাহলে কি আমিও ভুল জানি? মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য সংখ্যা হয়ত সাতই ছিল! আমার জানা ভুল হতেই পারে, কিন্তু ঐ সময়ের ইতিহাসের সূত্র বা স্মৃতিকথায় ত ভুল তথ্য থাকতে পারে না। সকল সূত্রেই একই তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। যেমন, শামসুল হুদা চৌধুরীর একাত্তরের রণাঙ্গন, মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম পিএসসির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মোজহারুল ইসলামের আমি স্মৃতি: আমি ইতিহাস (এভাবে তালিকা অনেক বড় করা যাবে) গ্রন্থে উল্লেখ আছে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার মন্ত্রীর সংখ্যা চার। আর যেহেতু তখন ছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার সেহেতু রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতিও মন্ত্রিসভার সদস্য হিসাবে গণ্য হতেন। সে হিসাবে মোট সদস্য সংখ্যা হয় ছয়।
এ বিষয়ে সর্বপেক্ষা নির্ভরযোগ্য তথ্য দেওয়া যাক। হাসান হাফিজুর রমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র-এর তৃতীয় খ-ের (মুজিবনগর: প্রশাসন) ‘বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা গঠন’ শীর্ষক সাত নম্বর দলিলে লেখা আছে- “A six member war cabinet headed by Sheik Mujibur
Rahman was formed in Bangladesh.....” । এখানে আরো উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ মন্ত্রিপরিষদের যে বৈঠক হয় সেখানেও দেখা যায় মন্ত্রীর সংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটেনি। তাহলে মন্ত্রিসভার সদস্য সংখ্যা সাত হলো কিভাবে? আর সে মিথ্যা ‘সাত’কে ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মিত হয় কি করে? হায়রে বাংলাদেশে! সত্যিই তুমি যে ‘সব সম্ভবের দেশ’। আর সেটা আরো একবার প্রমাণ হলো ‘মুক্ত বাংলা’য়, যা আজও বহন করে চলছে ইবি।
এ বিষয়ে আমার একটা লেখা তৎকালের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকা চলতিপত্র’র বর্ষ ২ সংখ্যা ৯ (৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮) এ প্রকাশিত হয়। সে লেখার শেষ লাইন ছিল এমন- শেষে প্রত্যাশা, বর্তমান সরকার ও বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন বিষয়টি আমলে নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু হায়! আজও কোন সরকার বা কোন ভিসি ‘মুক্ত বাংলা’কে মিথ্যার কলঙ্ক থেকে মুক্ত করার কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন বলে জানা নাই। আমার লেখাটি প্রকাশের পর সেটা ফটোকপি করে ভিসি অফিসে জমাও দিয়েছিলাম। তখন ভিসি ছিলেন বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের অনুসারি ড. কয়েস উদ্দিন। তবু কিছুই হয়নি। জানি না আজও সেই বৃথা চেষ্টাই করলাম হয়তো আবারো।
[ এ রচনাটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের রজতজয়ন্তী ও প্রথম এ্যলামনাই সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত ‘বন্ধন ২০১৭’তে প্রকাশিত হয়েছে।]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন