![]() |
কোলাজ: মো. শাহিনুর রশীদ, ১৯৯৪ খ্রি. সংগ্রহ ও ফটোগ্রাফ: সেলিম মাহমুদ রাজু |
কবে প্রথম বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার পরিচয় জানি না। আমার জন্মের আগেই সপরিবারে তাঁকে হত্যা করা হয়, বিধায় তাঁর সাথে আমার ব্যক্তি-পরিচয়ের প্রশ্ন ওঠে না। তবু মনে হয় তিনি আমার কত জনমের পরিচিত; তিনি আছেন আমার হৃদয় জুড়ে। আমি ও আমার পরিবারের কেউই সাংগঠনিকভাবে কোন রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে জড়িত নয়। তবু কী-ভাবে কী-কারণে বঙ্গবন্ধু আমার মনের মণিকোঠায় স্থান পেল? তাঁর সৌম্য দর্শনের ছবি, পরোপকারী কিশোর মুজিবের গল্প, সাহসী ছাত্র নেতা নাকি সম্মোহনী বক্তৃতাÑ কোনটা আমাকে আকর্ষণ করেছিল প্রথম? হয়ত কোন একটি কারণ নয় বা তাঁর চারিত্রিক অন্য কোন আবেশ আমাকে তাঁর পানে ধাবিত করে চলেছে।
আমি প্রথম দৈনিক পত্রিকা পড়তে শুরু করি অষ্টম শ্রেণির দিকে ১৯৯০ বা একটু আগে। তখন আমার এক চাচাত ভাই কখনও ইত্তেফাক কখনও ইনকিলাব রাখতেন। পত্রিকা পাওয়া যেত পরের দিন। তবে তখন মনে হয় পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু স্থান পেতেন না। অবশ্য তার আগেই আমাদের পারিবারিক গ্রন্থাগারে পেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সংকলন বজ্রকণ্ঠ, মেজভাইয়ের সংগ্রহে দেখেছি বঙ্গবন্ধুর হাস্যোজ্জ্বল ছবি। সে সময় হয়ত মাইকে বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণও শুনেছি। ১৯৯১-এর নির্বাচনে ভাইয়ের সাথে নৌকা প্রতীকের ব্যানার লিখেছি। গ্রামের দেওয়ালে নৌকা এঁকে লিখেছি নৌকা মার্কায় ভোট দিন। সেসব যে ভালোবেসে করেছি তা হয়ত নয়, কিন্তু তার প্রভাবও হয়ত পড়েছে মনে। সেই সময় শুনেছিÑ নৌকাকে ভোট দেওয়া যাবে না; নৌকা জিতলে বাংলাদেশ ভারত হয়ে যাবে, কেননা তখনও ২৫ বছরের গোলামী চুক্তি শেষ হয়নিÑ তাই নৌকা যেন না জিতে। একজন (তিনি এখনও বেঁচে আছেন) এসে বলছেÑ মুই দেকে আনু, চকিলামের ছাও মেশিন দিয়ে পিলারগুলা চরচর করে তোলোচে! (আমি দেখে এলাম চকিলামের [সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম] দিকে মেশিন দিয়ে সীমান্ত পিলারগুলো টেনে তুলছে)। কিছু মহিলা ছোট ছোট কোরআন শরীফ নিয়ে মহিলাদের শপথ করে নিচ্ছে- দাঁড়ি পল্লায় ভোট দিলে বেহেস্তের টিকিট পাওয়া যাবে। তবে ঐ নির্বাচনে জয় লাভ করেন আওয়ামী লীগের শহীদুজ্জামান সরকার (বাবলু ভাই); তখন তিনি জিতেছিলেন মূলত তাঁর ব্যক্তিগত ইমেজের কারণে (বর্তমানেও তিনি এমপি ও জাতীয় সংসদের হুইপ)। এমন সময়ে এরূপ এক গ্রামে আমি বেড়ে উঠি। এর পরও বঙ্গবন্ধু আমার মনে স্থান করে নেন। ঐ সময় বা তার অল্প আগে পরে আমার মেজভাই বঙ্গবন্ধুর একটি প্রতিকৃতি আঁকেনÑ সাদা-কালো, অক্সাইড ও আইকা গাম ব্যবহার করে। সে ছবিটি স্থান পায় থানা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে। মেজভাই বাবলুভাইয়ের খুব স্নেহভাজন ছিলেন; মনে হয় তাঁর দ্বারা অনুরুদ্ধ হয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর ছবি এঁকেছিলেন। বাজারে গেলে রাস্তা থেকেই ঐ ছবিতে দেখা যেত বঙ্গবন্ধুকে। কয়েক বছর আগেও ছবিটি তাদের কার্যালয়ে ঝুলতে দেখেছি, কিন্তু এখন আর নাই। তবে সেই সাদা-কালো ছবিই কি আমার মনে রেখাপাত করে?
১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে এসএসসি’র পর ভর্তি হই রাজশাহী চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে (আর্ট কলেজ)। আমাদের ক্লাস শুরু হয় বছরের শেষ দিকে। পরের বছরের গ্রীষ্মকালীন ছুটির পূর্ব পর্যন্ত আমি সে কলেজের ছাত্র ছিলাম। এর মধ্যে ক্লাসে বলা হলো আমাদের একটি কোলাজ ছবি জমা করতে হবে। আগে কোন দিন কোলাজ করিনি। কী করব ভাবছি। এমন এক সন্ধ্যায় রাবি স্টেশনে পত্রিকা স্টলের একটি পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর এক ছবিতে আমার দৃষ্টি আটকে যায়। তখনই স্থির করলাম বঙ্গবন্ধুকেই কোলাজের বিষয় করব। তাই পত্রিকাটি কিনে, ফিরলাম রুমে। তার পর কয়েক দিনের চেষ্টায় তৈরি হলো আমার বঙ্গবন্ধু। আমার খুব মনে পড়ে, ছবির বিষয় হিসাবে বঙ্গবন্ধুকে নির্বাচন করায় বন্ধুদের কেউ কেউ নম্বর কম ওঠার আশঙ্কা করেছিল। তবে আমি সে ছবিতে সম্ভবত সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলাম।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়ে বিপাকে পড়লাম, যখন আমি চারুকলার পাঠ শেষ না করেই (পারিবারিক বিপর্যয়ের কারণে) রাজশাহী ছেড়ে পাবনার সুজানগরে যাই। হার্ডবোডে বাঁধাই করা ছবিটি প্রথমে আমার চাচার বাসায় রেখে এলাম। আমার এই মুক্তিযোদ্ধা চাচা তখন সোনালী ব্যাংকে চাকরি করতেন। সুজানগর থেকেই খবর পেলাম বঙ্গবন্ধুকে বাসায় রাখা যাবে না। খবর পেয়ে আমি খুব অবাক হলাম। অনুভব করুন, তখনও বঙ্গবন্ধু কতটা আতঙ্কের বিষয় ক্ষমতাসীন সরকারের কাছে বা সরকারি কর্মকর্তাদের চিন্তা-জগতে। সে যাই হোক আমি রাজশাহী গিয়ে
‘বঙ্গবন্ধু’কে দিয়ে এলাম আমার স্কুল বন্ধু রাজুর মেসে। ওরা পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত। ও নিজেও এখন থানা আওয়ামী যুবলীগের সেক্রেটারি। এর পর থেকেই আমার সে
‘বঙ্গবন্ধু’র মালিক রাজু। সে আর কিছুতেই সেটা হাত ছাড়া করতে চায় না। তবে চাইতেই এ লেখার জন্য ফটোগ্রাফ পাঠিয়েছে। এসব ঘটনা আমার মনে হয় কারো কারো কাছে
‘আতঙ্কিত’ ও ‘নিষিদ্ধ’ বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমাকে আরো আকৃষ্ট হতে সাহায্য করেছে।
রাজশাহীতে থাকতে শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় দেখেছি মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন পত্রিকার ক্লিপিং। তখনই খেয়াল করেছি, যে-সব খবরে জামাতের কুকর্মের বিবরণ ছিল, সেগুলো কলমদিয়ে কালো করা বা কাটা। আর্ট কলেজে তখন বাংলা পড়াতেন মনসুর স্যার (হাশেম খানের ভাই)। তাঁর কাছেও মনে হয় মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর গল্প শুনেছি। মনে হয় পত্রিকার ক্লিপিং-এ ঘষামাজা বা কাটা এবং স্যারের বক্তৃতাও আমাকে প্রভাবিত করেছে।
মনে হয় সুজানগরের
‘প্রবাস’ কালেই বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের সাথে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ট হয়। সেখানে আমি ছিলাম প্রায় চৌদ্দ মাস। এখানে নিবিড় ভাবে পড়ার সুযোগ পেয়েছি সে সময়ের জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক জনকণ্ঠ ও দৈনিক সংবাদ এবং সাপ্তাহিক যায়যায়দিন। মনে হয় এ সময়ে আমার মানসে বঙ্গবন্ধুর প্রভাব সর্বাপেক্ষা বেশি প্রসারিত হয়। খুব মনে পড়ে মুনতাসির মামুনের
‘অল্পকথা’, মাহবুব কামালের
‘চতুর্থমাত্রা’সহ আনিসুল হক, স্বদেশ রায়, আবু সুফিয়ানের লেখা; এখনও সুধার মতো লাগে সেসব কথা। তবে ঐ সময় বিভিন্ন দিবসে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ মাইকে প্রচার করত। আমি একাএকা (আক্ষরিক অর্থেই অধিকাংশ সময় থাকতাম একা) সে ভাষণ শুনে শিহরিত হতাম; বিশেষত আগস্টে ডায়েরিতে বঙ্গবন্ধুর বাণী ও ছবি ভরে উঠত। একটা গানের কথাও খুব মনে পড়ে- যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই, গানটি প্রথম সুজানগরে না কুষ্টিয়াতে শুনেছি মনে নাই, তবে শোনার পর যে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম ও আফসোস অনুভূত হয়েছিল, এখনও তার রেশ রয়েছে মনে। এখনও প্রতি ১৪ আগস্ট মনে হয় যদি রাত পোহালেই শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই!
১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে এইচএসসি’র পর বঙ্গবন্ধু আমার সামনে আলো হয়ে আর্বিভূত হন। বছর খানেক ঢাকা, এর পর কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কালে বঙ্গবন্ধুকে অন্বেষণ আমার নেশায় পরিণত হয়। বিশেষত দৈনিক ইনকিলাব, সংগ্রাম, দিনকাল মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যে অপবাদ বা অভিযোগ অপপ্রচার করত, প্রতিনিয়ত তার প্রতি-উত্তর খুঁজতে গিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছি- বঙ্গবন্ধুর প্রগাঢ় দেশপ্রেমের প্রভায়। এসময় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত কবিতা ও গান (অডিও ক্যাসেটে) সংগ্রহ করা ছিল শখ। খুব মনে পড়ে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গাওয়া ভূপেন হাজারিকার- জয় জয় নবজাত বাংলাদেশ-এর কথা; গানটি সংগ্রহ করার জন্য অনেক দিন সম্ভাব্য সকল স্থানে খোঁজ করেছি। শেষে গানটি সংগ্রহ করে দিয়েছিল কুষ্টিয়ার ইসলামীয়া কলেজ গলিতে অবস্থিত অডিও ক্যাসেটের দোকান
‘সঙ্গীতা’।সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান- বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায় গানটিও আমি
‘সঙ্গীতা’ থেকে সংগ্রহ করেছিলাম। তখন আমার লেখা
‘জয় বাংলা আমাদের জাতীয় জয়ধ্বনি’ প্রকাশিত হয় তৎসময়ে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক চলতিপত্র-এ (বর্ষ ১, সংখ্যা ৩৬, ২৫ আগস্ট ১৯৯৭ খ্রি.) [এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন সাপ্তাহিক যায়যায়দিন চরিত্র পরিবর্তন করলে ঐ পত্রিকার মুক্তচিন্তার অধিকাংশ লেখকের সহযোগীতায় প্রকাশিত হয় চলতিপত্র]। তখন আমি লিখতাম
‘রশীদ-ই-তাকানম রহমান’ নামে। রশীদ-ই-তাকানম রহমান অর্থ: রশীদ হলো আমার নামের রশীদ, তা-এ তাজউদ্দীন আহমেদ, কা-এ (মো.) কামরুজ্জামান, ন-এ নজরুল ইসলাম, ম-এ (এম) মনসুর আলী আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমনের রহমান। এর পর ইবি ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাষ্কর্য
‘মুক্ত বাংলা’ যে মুজিব নগর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য সংখ্যা বিকৃত করে নির্মাণ করা হয়েছে, সে বিষয়ে আমার লেখা প্রকাশিত হয় (চলতিপত্র, বর্ষ ২, সংখ্যা ৯, ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮, পৃ. ২৮)।
এর পর কর্মজীবনে বঙ্গবন্ধু অধ্যয়ন অব্যহত থাকে কিন্তু আমার গবেষণার বিষয় হিসাবে বঙ্গবন্ধু বা মুক্তিযুদ্ধকে নির্বাচিত করতে পারিনি। তার কারণ আমি অনুভব করি বঙ্গবন্ধুর পরিসর যতটা বিস্তৃত তার হদিস করা জন্য যে মেধা ও যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন তা আমার নাই। তবে বঙ্গবন্ধুর পাঠ গ্রহণ অব্যহত আছে এবং আছে বলেই মনে হয় বঙ্গবন্ধুকে আমাদের লেখক-গবেষকগণ সম্পূর্ণ
‘আবিষ্কার’ করতে পারেননি। কত বিষয় রয়েছে যে সেসব বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর কৃতিত্ব মূল্যায়ণ করা হয়নি। যেমন, শুধু বাঙালিদের মধ্যেই যেখানে এত ভেদ, এত বৈপরীত্য, এত ভিন্নতা সেখানে বঙ্গবন্ধু পূর্ব-বাংলার সমগ্র জনগণকে কী করে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন? বঙ্গবন্ধুর সে সক্ষমতার মূল্যায়ন মনে হয় আজও আমরা করতে পারিনি। আবার আমারা জানি একটি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা; ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় এটি পরীক্ষিত সত্য। আজ প্যালেস্টাইনরা অনুভব করছে সে সত্য এবং স্বাধীনতার মূল্য কত? এ প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুকে আমরা কি অনুভব করি? তিনি যে-পরিচয় আমাদের দিয়ে গেছেন তার গুরুত্ব এখনও পুরাপুরি আমরা বুঝিনি। আমরা আছি কে আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ বিরোধী এই নিয়ে। এখনও অনেকাংশে বঙ্গবন্ধু শুধুই আওয়ামী লীগের- তাঁর কৃতিত্বের কথা বললেই মনে করা হয় আওয়ামীপন্থী। সম্ভবত এ কারণেই পণ্ডিতগণ সমকালীন ঘটনা ইতিহাস-গবেষণার বিষয় হিসাবে যৌক্তিক মনে করেন না। আজ আমি অপেক্ষায় আছি কবে বঙ্গবন্ধুর সম্পূর্ণ আলোকবর্তিকায় আমার প্রিয় দেশবাসীসহ বিশ^বাসী উদ্ভাসিত হবে।